বিশেষ প্রতিনিধি, কিশোরগঞ্জ ।।
গলিটার নাম সবুজবাগ। চরশোলাকিয়া এলাকার নিরিবিলি একটি গলি। শোলাকিয়া ঈদগাহের উত্তর-পশ্চিম কোণার দিকে এর অবস্থান। গলির মাঝামাঝি স্থানের ১০৯৭ নম্বর বাসাটিই ভৌমিক নিবাস। বৃহস্পতিবার ৬ জুলাই বিকেলে এ বাসার সামনে গেলে শোকের আবহ চোখে পড়ে। বাসার সামনে টানানো হচ্ছে সামিয়ানা। চলছে পরম করুণাময়ের কাছে বিদেহি আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনার আয়োজনের প্রস্তুতি।
ছোট পুরনো বাসাটির পশ্চিম দিকের সবুজ রঙের দেয়ালের মাঝামঝিতে টিনের জানালা। জানালাটার নিচেই কালো রঙের ওপরে সাঁটানো মমতা মাখানো একটি ছবি। নাম লেখা, ‘শহীদ ঝর্ণা রাণী ভৌমিক’। এই জানালার টিন ভেদ করেই লেগেছিল গুলিটা। মাকে স্মরণে রাখতে দুই ছেলে সাঁটিয়েছে এই ছবি।
গত বছরের ঈদুল ফিতরের দিন মুসলিম পরিবারগুলোর মতো এ পরিবারেও রান্না হয়েছিল ফিরনি পায়েশ। সবার জন্য কেনা হয়েছিল নতুন জামা। ঈদের দিনে ছোটবেলার মুসলিম বন্ধুদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগি করতে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসেন বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক (৩৪)। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজের খণ্ডকালীন শিক্ষক। হাঁসের গোশত তার পছন্দ। মা ঝর্ণা রাণী ভৌমিক হাঁস রান্না করেন তার জন্য। ছোট ছেলে শুভদেব (১২) সকালেই চেঁচামেচি শুরু করে সাজিয়ে দেয়ার জন্য। নতুন জামা পরে ঈদের জামাত দেখতে যাবে বন্ধুদের সাথে। ঘড়িতে তখন পৌনে নয়টা বাজে। হঠাৎ বোমার শব্দ। একটু পরেই গোলাগুলির শব্দ। খবর এলো বাসার ৫০ গজ দূরে আজিম উদ্দিন স্কুলের পাশে পুলিশ-উগ্রবাদীদের মধ্যে গোলাগুলি চলছে। দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘরে ঝর্ণারাণীর বাসার সবাই ভয়ে জড়োসড়ো। আশপাশের বাসার লোকজনও তাদের দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়েছে। উগ্রবাদীরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে দুই পুলিশকে মেরে সবুজবাগ গলি থেকে পুলিশের ওপর গুলি ছুঁড়ছে। নিক্ষেপ করছে হাতবোমা। বিপরীত দিক থেকে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুঁড়ছে। এর মধ্যে একটি গুলি টিনের জানালা ভেদ করে ঘরের ভেতর থাকা ঝর্ণা রাণীর মাথায় এসে লাগে। সাথে সাথেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
দুই ছেলে ও স্বামীকে নিয়ে চার সদস্যের সংসার মমতা দিয়ে আগলে রেখেছিলেন ঝর্ণা রাণী। ঝর্ণা রাণীর মৃত্যুর এক বছর ৬ জুলাই বৃহস্পতিবার। তার মর্মান্তিক মৃত্যুর শোক এখনো ভুলতে পারছেন না পরিবারের সদস্যরা। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। ঝর্ণা রাণীর স্বামী গৌরাঙ্গ ভৌমিক জানান, ঝর্ণারাণী মারা যাওয়ার পর থেকে ঘরে তাদের ভালো কোনো রান্না হয় না। সংসারের সব এলোমেলো হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, ‘ছোট ছেলে শুভদেব মায়ের ছবি নিয়ে এখনো কাঁদে। বাইরে কোনো কিছুর শব্দ হলেই ভয়ে আতঁকে ওঠে সে। রাতে ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করে প্রায়ই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ঘুমানোর আগে দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ করতে বলে আমাকে। তিনি আরো বলেন, ‘মা মারা যাওয়ার পর শুভকে ময়মনসিংহের একটা স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করানো হয়েছে। মা ছাড়া ও কোনোদিন দূরে থাকেনি। সেখানেও থাকতে চায় না। বাড়িতে ও এখন আমার সাথেই ঘুমায়। গত পরশু রাতে দেখি, আমার পায়ের কাছে বসে ডুকরে কাঁদছে। জড়িয়ে ধরলে বলে, আমি মার কাছে যাব। ওর মা বেঁচে থাকলে যে বিষয়গুলো নিয়ে আমাকে ভাবতে হতো না, তা-ও ভাবতে হচ্ছে। আমি তাকে মায়ের আদর দিতে চেষ্টা করি। কিন্তু একজন বাবা তো আর মা হতে পারে না। রাত হলেই ছেলেটার জন্য চিন্তা বাড়তে থাকে।’
বড় ছেলে বাসুদেব ভৌমিক বলেন, ‘মা ছাড়া আমরা এখন অসহায়। কী যে শূণ্যতায় ভুগছি আমরা! ছোট ভাইটাকে নিয়ে চিন্তায় আছি বেশি। ও মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। সারাদিন ঝিম মেরে বসে থাকে। বাইরে খেলাধুলা করতে যায় না। আর অসুস্থ হবেই না কেনো, ও তো সব সময় মায়ের আঁচল ধরেই থাকতো। ওকে আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া, গল্প শোনানো, মুখে তুলে ভাত খাওয়ানো মা-ই সব করতো।’
বৃহস্পতিবার বিকেলে শোলাকিয়ার সবুজবাগ গলির ভৌমিক নিবাসে গিয়ে দেখা যায় বাড়ির বড়রা শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ত। শুভদেব একটা কক্ষে মায়ের ছবি নিয়ে বসে আছে। ওর থাকার ঘরে বালিশের পাশে মায়ের ছবি। মন খারাপ হলে ও মায়ের ছবি দেখে। ছবিতে হাত বুলায়। দিনের বড় একটি অংশ কাটে তার মায়ের ছবি নিয়ে।